কোরবানী ঈদের দিন করনীয় ও বর্জনীয়
টাইমস বাংলা নিউজ ২৪.কম ইসলামিক ডেস্কঃ ঈদ মানে আনন্দ ঈদ মানে খুশি। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সবথেকে বড় দুটি উৎসব রয়েছে,একটি হলো ঈদুল ফিতর আর অপরটি হলো ঈদুল আজাহা। প্রিয় পাঠক আজকে আমরা ঈদুল আজাহা সম্পর্কে আলোচনা করতে যাচ্ছি। তাহলে চলুন বিস্তারিত দেখে আশি।
ঈদুল আজহা পরিচিতিঃ আরবি শব্দ ঈদ উল আযহা বা ঈদ উল আজহা বা ঈদ উল আধহা অর্থ ত্যাগের উৎসব। এই উৎসবটি কুরবানির ঈদ নামেও পরিচিত। এই ঈদকে ঈদুজ্জোহাও বলা হয়। এই উৎসবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল ত্যাগ করা। এ দিনটিতে মুসলমানেরা ফযরের নামাযের পর ঈদগাহে গিয়ে দুই রাক্বাত ঈদুল আযহার নামাজ আদায় করে এবং পরে স্ব-স্ব আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ ও উট আল্লাহর নামে কোরবানি করে।
ঈদুল আজহা কবে উজ্জাপিত হয়ঃ ঈদুল আজহা কবে উজ্জাপিত হয় বা পালন করা হয়। ইসলামি চান্দ্র পঞ্জিকায়, ঈদুল আযহা জ্বিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখে পালন করা হয়। ঈদের তারিখ স্থানীয়ভাবে জ্বিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে।ঈদুল আজহার উৎপত্তি বা ইতিহাসঃ ইসলামের বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী মহান আল্লাহ তাআলা ইসলামের রাসুল হযরত ইব্রাহীম (আ) কে স্বপ্নযোগে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি কুরবানি করার নির্দেশ দেন তিনি বলেন-তুমি তোমার প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে কোরবানি কর।
ইব্রাহীম (আ) স্বপ্নে এ আদেশ পেয়ে ১০টি উট কোরবানি করলেন। পুনরায় তিনি আবারো একই স্বপ্ন দেখলেন। অতঃপর তিনি এবার ১০০টি উট কোরবানি করেন। এরপরেও তিনি একই স্বপ্ন দেখেন। হযরত ইব্রাহীম (আ) ভাবলেন,আমার কাছে তো এ মুহূর্তে প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ) ছাড়া আর কোনো প্রিয় বস্তু নেই। তখন তিনি পুত্রকে কোরবানি করার উদ্দেশ্যে প্রস্তুতিসহ আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশে যাত্রা করেন।
এ সময় শয়তান আল্লাহর আদেশ পালন করা থেকে বিরত করার জন্য ইব্রাহীম ও তার পরিবারকে প্রলুব্ধ করেছিল, এবং ইব্রাহীম শয়তানকে পাথর ছুঁড়ে মেরেছিলেন। শয়তানকে তার প্রত্যাখ্যানের কথা স্মরণে হজ্জের সময় শয়তানের অবস্থানের চিহ্ন স্বরূপ নির্মিত ৩টি স্তম্ভে প্রতীকী পাথর নিক্ষেপ করেন হাজীরা।
যখন ইব্রাহীম (আ.) আরাফাত পর্বতের উপর তার পুত্রকে কোরবানি দেয়ার জন্য গলদেশে ছুরি চালানোর চেষ্টা করেন, তখন তিনি বিস্মিত হয়ে দেখেন যে তার পুত্রের পরিবর্তে একটি প্রাণী কোরবানি হয়েছে এবং তার পুত্রের কোনো ক্ষতি হয়নি। ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর আদেশ পালন করার দ্বারা কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এতে সন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ ইব্রাহীম (আ) কে তার খলিল (বন্ধু) হিসাবে গ্রহণ করেন।
ঈদুল আজহায় করণীয়
উত্তমরূপে গোসল করা : ঈদের নামাজের আগে উত্তমরূপে গোসল করা সুন্নাত।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা:) হতে বর্ণিত,মহানবী (সা:) ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে উত্তমরূপে গোসল করতেন। (মুয়াত্তা ইমাম মালিক)
উত্তম পোশাক পরিধান : ঈদের দিন রাসুল (সা:) ভালো পোশাক পরিধান করতেন। সামর্থ্য থাকলে নতুন পোশাক পরিধান করা। হাদিসে এসেছে,রাসুল (সা.)-এর লাল ও সবুজ ডোরার একটি চাদর ছিল, তিনি তা দুই ঈদ ও জুমার দিন পরিধান করতেন।
সুগন্ধি ব্যবহার করা : সুগন্ধি ব্যবহার করা সুন্নাত। আর ঈদের দিনে মহানবী (সা:) বিশেষভাবে সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। হযরত রাসুল (সা:)-এর তিনটি পছন্দনীয় জিনিসের মধ্যে একটি হলো সুগন্ধি। তাই ঈদের দিনের পোশাক পরিধানের পর সুগন্ধি ব্যবহার করা মানে নবীর সুন্নাতের আমল করা।
ঈদের দিনে খাবার খাওয়া : কোরবানির দিনে ঈদের নামাজের আগে কিছু না খাওয়া মুস্তাহাব। নবী করিম (সা:) ঈদুল আজহার দিন নামাজ আদায় করার আগ পর্যন্ত কিছু খেতেন না। (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ)
ঈদগাহে যাওয়া আসা : ঈদগাহে একপথ দিয়ে যাওয়া ও অন্যপথ দিয়ে ফেরা সুন্নাত। (বুখারি, হাদিস : ৯৮৬) সম্ভব হলে ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়াও সুন্নাত। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১০৭১)
তাকবির পাঠ করা : ঈদের দিন তাকবির পাঠের মাধ্যমে আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করা সুন্নাত। পুরুষরা এ তাকবির উঁচু আওয়াজে পাঠ করবে,মেয়েরা নীরবে। এ তাকবির জিলহজ মাসের ৯ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত পাঠ করবে। (ফাতহুল বারি : ২/৫৮৯)
কোরবানীর ঈদের তাকবিরঃ আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার,লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু,ওয়াল্লাহু আকবার ওয়াল্লাহু আকবার,ওয়া লিল্লাহিল হামদ।
কোরবানী ঈদের নামাজ আদায় : ঈদের নামাজ সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। ঈদের নামাজ সব সুন্নাত নামাজের মধ্যে ফজিলতপূর্ণ। ঈদের নামাজের আগে ও ফজরের নামাজের পরে কোনো নামাজ নেই। ঈদের নামাজের কোনো আজান ও ইকামত নেই।
শুভেচ্ছা বিনিময় : ঈদের দিনে ছোট-বড় সবার সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা সুন্নাত। ঈদের দিনে সাহাবায়ে কিরামদের সম্ভাষণ ছিল-তাক্বাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা।
কোরবানি করাঃ ঈদুল আজহার দিনে সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। কোরবানির গোশত নিজে খাবে,নিজের পরিবারবর্গকে খাওয়াবে আত্মীয়-স্বজনকে হাদিয়া-তোহফা দেবে ও গরিব-মিসকিনকে দান করবে।
কোরবানির গোশতের ভাগঃ মুস্তাহাব হলো-কোরবানির গোশত তিন ভাগে ভাগ করা।
১.নিজ পরিবার-পরিজনের জন্য এক ভাগ।
২.আত্মীয়-স্বজনের জন্য এক ভাগ।
৩.দরিদ্রদের জন্য এক ভাগ। আর যদি পরিবারের লোকসংখ্যা বেশি হয়,তাহলে কোরবানির সব গোশত খেলেও অসুবিধা নেই। (শামী ৫/২০৮)
পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা : ঈদুল আজহায় পশুর রক্ত, আবর্জনা ও হাড় থেকে যেন পরিবেশ দূষিত না হয়,সে দিকে প্রত্যেক মুসলমানের সতর্ক হওয়া উচিত। কোরবানি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্ত,আবর্জনা ও হাড় নিরাপদ দূরত্বে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে পুতে রেখে দিতে হবে। বেশির ভাগ লোকই নিজস্ব জায়গায় পশু জবাই করে। এতে করে অলিগলিতে বর্জ্য যেমন পড়ে, তেমনি রক্ত পড়ে দূষিত হয় পরিবেশ, চলাচলের অনুপযোগী হয় রাস্তাঘাট। তাই ঈদুল আজহায় পশুর রক্ত, আবর্জনা পরিষ্কারে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবেও উদ্যোগ গ্রহণ করে পরিবেশ দূষণের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ।
ঈদুল আজহা বা কোরবানির দিনে বর্জনীয়
ঈদের দিনে রোজা রাখা: ঈদের দিনে রোজা রাখা হারাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিনে রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
ঈদের দিন কবর জিয়ারত করা: ঈদের দিনকে কবর জিয়ারতের বিশেষ দিন মনে করে জিয়ারত করা বিদআত (সহিহ ফিকহুস সুন্নাহ : ১/৬৬৯) তবে পূর্বনির্ধারিত রুটিন ছাড়া হঠাৎ সুযোগ হয়ে গেলে একাকী কেউ জিয়ারত করলে দোষণীয় নয়।
ঈদের সালাত আদায় না করে শুধু আনন্দ-ফূর্তি করা: অনেকে ঈদের আনন্দে মশগুল হয়ে নতুন জামা-কাপড় পরিধান,সেমাই,ফিরনি ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে,ঈদের সালাত আদায় করার কথা ভুলে যায়। অথচ এই দিনে ঈদের সালাত ও কোরবানি করাই হচ্ছে মুসলমানদের মূল কাজ। তাই ঈদের দিন নামাজ আদায় না করে আনন্দ-ফূর্তি নিয়ে মেতে থাকা যাবেনা।
মুসাফাহা-মুয়ানাকা এ দিনে জরুরি মনে করা: ঈদগাহে বা ঈদের দিন সাক্ষাৎ হলে মুসাফাহা ও মুয়ানাকা করতেই হবে-এমন বিশ্বাস ও আমল করা বিদয়াত। তবে এমন বিশ্বাস না করে সালাম ও মুসাফাহার পর মুয়ানাকা (গলায় গলা মিলানো) করায় কোনো অসুবিধা নেই। কারণ মুসাফাহা ও মুআনাকা করার মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি হয়।
হাদিসে এসেছে,আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত,একদা হাসান ইবনে আলী (রা:) নবী করিম (সা:)-এর কাছে এলেন,তিনি তখন তাঁকে জড়িয়ে ধরেন ও মুআনাকা (কোলাকুলি) করেন।
কোরবানির কোনো কিছু বিক্রি করা: কোরবানির গোশত,চামড়া ও এর কোনো অংশ বিক্রি করা। কোরবানির কোন কিছু বিক্রি করে নিজে উপকৃত হওয়া যাবে না। এমনকি কসাইকে পারিশ্রমিক স্বরূপ গোশত দেওয়াও নিষিদ্ধ। যেটা আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত। (বুখারি, হাদিস: ১৭১৭,মুসলিম,হাদিস :১৩১৭) তবে সাধারণভাবে তাকে খেতে দেওয়ায় অসুবিধা নেই।
ঈদ উপলক্ষে গান-বাজনা করা অশ্লীল সিনেমা ও নাটক দেখা : ঈদের দিন উপলক্ষে যেখানে গান-বাজনা,অবাধে নারী-পুরুষ বিচরণ ইত্যাদির আয়োজন থাকে,এমন মেলা আয়োজন করা,অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা দেওয়া সম্পূর্ণ হারাম। অনুরূপ ঈদ উপলক্ষে বাড়িঘরে গান-বাজনার বিশেষ আয়োজন,নারী-পুরুষের বিশেষ সাক্ষাৎ ও অবাধে যেখানে-সেখানে ঘোরাফেরা অমুসলিমদের কালচার। মুসলিমদের জন্য এগুলো সম্পূর্ণ হারাম।
(সুরা আলে ইমরান,আয়াত :১৪৯, সুরা লুকমান,আয়াত : ৬,৭)